পোড়া বাড়ি

Horror
3 out of 5 (2 Ratings)
Share this story

প্রথম অধ্যায় – (বাড়ী’র সন্ধানে)

#২৮শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ইংরেজী

দিনটি ছিল শুক্রবার। ঘড়ির কাটা ১২টা বেজে ৩০মিনিট। হালকা বাতাস ও কড়া রোদের আবহাওয়ায়, দূর থেকে মধুর সুরে ভেসে আসছে আযানে’র ধ্বনি’। আযানে’র ধ্বনি শুনা মাত্রই দলে দলে লোকজন মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে।

অন্যদিকে আযানে’র শব্দে ঘুম ভাঙলো ফারাবী’র। ফারাবী তার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তার একটি ছোট বোন আছে। যার বয়স মাত্র ৫বছর। ফারাবী ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়ালেখায় ভালো হলেও ঘুমের বেলায় তিনি বেশ দক্ষ। যদিও তিনি এই বিষয়টা’র জন্য তার বাবা’র কাছে বকা খেয়েই দিন শুরু করে। কিন্তু আজ আর তা খেতে হলো না, কারণ ইতিমধ্যেই তার বাবা জনাব, ইকবাল হাসান নামাজে’র উদ্দেশ্যে মসজিদের দিকে রওনা দিয়েছেন।

বিছানা থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো তিনি রুমের বারান্দার দিকে অগ্রসর হলেন। এবং বারান্দায় এসে দেখলেন বাহিরে’র পরিবেশ’টা বেশ শোরগোলে মাতানো। কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ শোরগোল’টা বন্ধ হয়ে গেল, ফারাবী লক্ষ করলো বাতাসের সাথে ভেসে আসছে খুতবা’র শব্দ।

তিনি মুচকি হেসে ভাবতে লাগলেন – পরিবেশ’টা কত নীরব হয়ে গেলো! মনে হচ্ছে পুরো শহরটি একসাথে খুতবা শুনার জন্য প্রস্তুত। আর খুতবা শুনারই কথা, হাজার হোক জুম্মাবার তো।

​ফারাবী এসব ভাবতে ভাবতেই পিছন থেকে শুনতে পেলেন তার মা তাকে নামাজে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে। তিনি আর দেরী না করে নিজেকে নামাজে’র জন্য প্রস্তুত করতে লাগলেন, এবং কিছুসময় পর তিনি নিজেও নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদে রওনা দিলেন। নামাজ পরে বাড়ি ফিরে এলে, দুপুরে’র খাবার শেষে তিনি আবার বিছানায় গিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দেন।

​ঘড়িতে সময় দুপুর ০৩টা বেজে ১৫মিনিট।

– ক্রিং ক্রিং — ক্রিং ক্রিং — ক্রিং ক্রিং – শব্দে ফোন বেজেই চলছে। কিন্তু ফোন ধরার মতো বাসায় কেউই ছিলো না, এইভাবে কিছু সময় ফোন বেজে চললো। অবশেষে কোনো কুল-কিনারা না পেয়ে ফারাবী ফোন’টা ধরতে বাধ্য হলো। ফোন ধরার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো — কি ব্যাপার! ফোন ধরছো না কেন?
ফারাবী ঘুম ঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন – কে বলছেন? ওপাশ থেকে বলে উঠলো আমি সায়েদ । ফারাবী বললেন – হ্যাঁ বলো…
সায়েদ :- তাড়াতাড়ি বিপ্লব উদ্যান আসো। কিছু জরুরী কথা আছে। আমি আর তানভীর তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
ফারাবী :- আচ্ছা ঠিক আছে, আসছি।

​এই বলে ফারাবী ফোনের লাইন’টি কেটে দেয়। এবং তৈরী হয়ে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্যের দিকে যেতে যেতে ফারাবী খুবই দুশ্চিন্তা অনুভব করে, কারণ সায়েদ এবং তানভীর তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, এছাড়াও তারা তিনজন একই কলেজে পড়াশোনা করে। সায়েদ ও তানভীর গ্রামের ছেলে। তারা দু’জনেই ভালো একটি কলেজে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে গ্রাম ত্যাগ করেছে। ফারাবী ছাড়া তাদের কেউ নেই এই শহরে।

এসব ভাবতে ভাবতেই তিনি গন্তব্যে পৌঁছে যায়, এবং তাদের দেখে ঠিক তার পাশের খালি আসনটি’তে তিনি অবস্থান করেন। সায়েদ ও তানভীর তাকে দেখে অনেক খুশি হয়। এবং জানতে চায় তিনি ফোন ধরছিলো না কেনো? কি হয়েছে?
উত্তরে ফারাবী বলেন- তিনি ঘুমে ছিলেন তাই ধরতে পারেন নি! এই কথা শুনে তারা দু’জন না চাইতেও হাসলেন এবং তানভীর জিজ্ঞেস করলেন- এটা কবে শেষ হবে?
ফারাবী কথার মাহিত্ব বুঝতে না পারায় বললেন কি শেষ হবে? তানভীর বললেন- কি আবার তোমার ঘুম! তানভীরে’র কথা শুনে ফারাবী হেসে বললেন হবে.হবে. ধৈর্য রাখো। অতঃপর তারা তিনজনই হাসতে লাগলেন।

কিছু সময় হাসি ঠাট্টা করার মাঝে ফারাবী’র মনে পড়লো তারা তাকে জরুরী কিছু কথা বলবে বলেছিলো! তখনই ফারাবী বলে উঠলেন- আচ্ছা সায়েদ, তুমি আমায় জরুরী কিছু কথা বলবে বলছিলে? কি কথা বলতো?
ঠিক তখনই সায়েদের’ও কথা’টা মনে পড়ে যায়। তখন তিনি বলেন —
সায়েদ :- আমরা যে বাসায়’টায় ভাড়া থাকতাম ওই বাসা’র দারোয়ান চাচা আজ সকালে বাসায় আসেন। এবং বলেন ০১তারিখ থেকে বাসা ছেড়ে দিতে, বাড়িওয়ালা নাকি এখানে ফ্যামিলি বাসা ভাড়া দিবে।
তানভীর :- তাই আমাদের এখন খুব জরুরী একটি বাসা দরকার? ০১তারিখ আসতে আর মাত্র ০২দিন বাকি।

তাদের দু’জনের কথা শুনে ফারাবী আবার একটু চিন্তায় পরেন। অপরদিকে তানভীর বলে উঠলো তোমাদের ওইদিকে নিশ্চয়ই বাসা ফাঁকা আছে?
​উত্তরে ফারাবী বলেন –
ফারাবী :- আমাদের ওদিকে বাসা ফাঁকা নেই আর এমনিতেও কলেজ থেকে আসা যাওয়া অনেক দুর হয়ে যাবে। আমার আব্বুও কলেজের আসে পাশে বাসা খুঁজছেন! আর তাছাড়া আমার পরিবার ০১মাসের জন্য গ্রামের বাড়ী যাবে, তো আমি চিন্তা করছিলাম এই একমাস তোমাদের সাথে থাকবো। কিন্তু….?

ফারাবী’র মুখে এসব কথা শুনে তারা দু’জনেই চিন্তায় ঢলে পড়লেন। তাদের’কে চিন্তিত দেখে ফারাবী উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন চলো!
সায়েদ কোথায় জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন বাসা খুঁজতে! এই কথা শুনে তাদের দু’জনেরই চিন্তা’র ঘোর কাটলো। এবং মনে কিছুটা খুশি অনুভব করে তারাও ফারাবী’র সাথে বাসা খুঁজতে বেরিয়ে পরলো।

দীর্ঘ ২ঘন্টা যাবত বিভিন্ন এলাকা’র অলি গলি খুঁজেও বাসা না পেয়ে তিনজনেই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এবং একটি টং দোকানে চা খাওয়ার বিরতি নেয়। চা খাওয়া শেষ করে ফারাবী দোকানদার মামা’র কাছে তিনটি গোল্ডলিফ সিগারেট চায়। এবং তিন বন্ধু একসাথে ধুমপান করে। ধুমপানের একটি পর্যায়ে তানভীর দোকানদার মামা’কে জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা মামা, এদিকে আশেপাশে কোনো ব্যাচেলর বাসা আছে ভাড়া নেওয়ার মতো?

​দোকানদার মামা বলেন – আপনারা এই রাস্তা ধরে সামনের দিকে ১০মিনিট হাঁটলে একটা গলি দেখতে পাবেন, আমার জানা মতে ওই গলি’তে একটা ব্যাচেলর বাসা খালি আছে। আপনারা ওই গলিটা’য় দেখতে পারেন।

তানভীর দোকানদার মামা’কে ধন্যবাদ জানায় এবং তিনজনই ধুমপান শেষ করে সামনের গলিটা’র দিকে রওনা দেয়। কিছুটা দূর আসার পর তারা একটি সাইনবোর্ড দেখতে পায়, যেখানে হলুদ রংয়ের কালিতে লেখা আনন্দ নগর, চন্দনপুরা, চট্টগ্রাম। বোর্ডটি দেখে সায়েদ বলে উঠলেন – হয়তো এটাই সেই গলি!

ফারাবী জবাবে বলেন – হয়তো!

অতঃপর তারা তিনজন সেই গলিটি’তে প্রবেশ করে। এবং গলির ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই তারা একটি বাড়ীর দেয়ালে পোস্টার দেখতে পায়, পোস্টারে লেখা ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হবে। ফারাবী তাৎক্ষণিক পোস্টারে’র নিচে দেওয়া নাম্বার’টি তে কল দেয়। এবং দু’বার রিং বাজার পর একজন ভদ্রলোক ওপাশ থেকে বলে উঠেন – হ্যালো. হ্যালো কে বলছেন?

​উত্তরে ফারাবী সালাম দিয়ে বলেন- আংকেল আমি ফারাবী, আমরা একটি ব্যাচেলর বাসা খুঁজছিলাম, আনন্দ নগর গলিতে আপনার পোস্টার’টা দেখে আমরা আপনাকে কল করি।
ওপাশ থেকে ভদ্রলোক’টি বললেন- আমরা বলতে তোমরা ক’জন?
ফারাবী উত্তরে বলেন- আমরা তিনজন।
তখন সেই ভদ্রলোক’টি বলেন – দেখো, পোস্টার’টা লাগানো হয়েছে আজ অনেক দিন। ইতিমধ্যে ভাড়া হয়ে গেছে, তবে আমার কাছে একটা সিট খালি আছে একজনের থাকার মতো। এখন তোমরা ভেবে দেখো!
ফারাবী ঠিক আছে বলে লাইন’টি কেটে দেয়। সায়েদ ও তানভীর “কি হলো” জিজ্ঞেস করায়? ফারাবী বলেন – বাসা ভাড়া হয়ে গেছে আর একটি সিট খালি আছে। যেকোনো একজন থাকতে পারবে।

এতো খুঁজার পরেও বাসা না পেয়ে তিন বন্ধুর মুখে আবার চিন্তা’র ছাপ দেখা দেয় এবং একটা সময় তানভীর বলেন – ফারাবী এখন কয়টা বাজে?
ফারাবী জানান ৫টা ১৫মিনিট। তানভীর বলেন – তাহলে চলো এই গলির আর একটু সামনে এগিয়ে দেখি যদি বাসা পাওয়া যায়!

​তিন বন্ধু বাসা খুঁজার উদ্দেশ্যে আবার হাঁটতে লাগলেন এবং একটু সামনে দেখতে পেলেন দু’টো বাড়ী। তারা তিনজন বাড়ীগুলোর দারোয়ান’দের সাথে কথা বলে জানতে পারলেন এখানে কোনো ব্যাচেলর বাসা নেই, এবং ফারাবী মনে কিছুটা আশা নিয়ে একটি দারোয়ান’কে জিজ্ঞেস করলেন – চাচা, সামনে আর কোনো বাড়ি আছে কি? দারোয়ান চাচা উত্তর দিলেন না।

​এই শুনে ফারাবী এবার অনেকটা চিন্তায় পরলেন। এবং পাশের একটি টং দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে জ্বালালেন। ফারাবী ধুমপান করতে করতে কিছুটা সামনের দিকে অগ্রসর হলে তিনি একটা বাড়ীর সম্মুখীন হন। বাড়ী’টি দেখতে ছিল চার তলা বিশিষ্ট আর বেশ পোড়া। বাড়ীর প্রতিটি দেয়ালে পোড়ার ছাপ এখনো যেনো স্পষ্ট। ফারাবী হাত থেকে সিগারেট’টা ফেলে গেইটের সামনে যেতেই তার ফোন বেজে উঠলো, ফোনটি ছিলো সায়েদের। ফোনটি রিসিভ করায় সায়েদ বললেন তুমি কোথায় আছো? তিনি উত্তরে সামনে দিকে আসতে বলে লাইন’টা কেটে দেয়।

তারপর আস্তে আস্তে গেইটের সামনে যায়, ফারাবী গেইটে’র বা পাশে লক্ষ্য করে দেখে ছোট্ট একটি বোর্ডে কিছু লেখা! কিন্তু ধুলো বালির কারনে লেখাটি একদমই বোঝা যাচ্ছিলো না, তাই তিনি হাত দিয়ে ধুলোবালিগুলো সরাতে গিয়ে দেখেন, ছোট্ট বোর্ডটি’তে লেখা “জলসা কুটির”। কিন্তু একি! দারোয়ান চাচা তো তাকে বলেছিলো সামনে আর কোনো বাড়ী’ই নেই!

এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ আচমকা একটি বৃদ্ধ লোককে দেখে তিনি বেশ অবাক হোন। বৃদ্ধ লোকটি দেখতে বেশ খাটো ছিল, চুলবিহীন মাথা নিয়ে মুখে পাকনা সাদা রংয়ের হাল্কা হাল্কা দাঁড়ি। ফারাবী লোকটির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

হঠাৎ বৃদ্ধ লোকটি জোর গলায় ঠমক দিয়ে বললো-

বৃদ্ধ লোক :- কি হলো জবাব দিচ্ছো না কেন?

ফারাবী চমকে উঠে বলে-
ফারাবী :- দুঃখীত, আপনি কি আমায় কিছু বলেছেন?
বৃদ্ধ লোক :- তুমি কি চোখ খোলা রেখে ঘুমাচ্ছিলে? যেন আমার কথা তুমি কিছুই শুনতে পাওনি! কে তুমি? কোথা থেকে এসেছো? কেনো এসেছো? আর এরা কারা?

ফারাবী কিছুটা অবাক হয়ে পিছনে ফিরে দেখে ইতিমধ্যে তার বন্ধুরা চলে এসেছে। কিছুটা সাহস নিয়ে সে বলে-
ফারাবী :- আ…আমার নাম ফারাবী, আর এরা আমার বন্ধু সায়েদ ও তানভীর। আমরা এই শহরেই থাকি, আমরা একটা ব্যাচেলর বাসা খুঁজছিলাম থাকার জন্য? কিন্তু আপনি কে?
বৃদ্ধ লোক :- আমি এ বাড়ীর মালিক। এটা আমার বাড়ী। আর আমায় বলছো আমি কে?

বৃদ্ধ লোকের কথা শুনে সায়েদ বললেন-
সায়েদ :- দুংখীত আংকেল, কিছু মনে করবেন না। আসলে আমাদের একটা বাসা খুবই জরুরি! আপনার এখানে কি কোনো বাসা খালি আছে?
বৃদ্ধ লোক :- আছে! থাকতে পারবা তো?

বৃদ্ধ লোকের কথা শুনে তিন বন্ধু কিছুটা অবাক হয়। এবং সায়েদ বলে উঠলো –
সায়েদ :- কি বলছেন আংকেল! কেনো থাকতে পারবো না?

সায়েদে’র কথার বিপরীতে তানভীর বলেন – বন্ধু দেখে মনে হচ্ছে এটা পোড়া বাড়ী! এখানে কে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবে?

তানভীরে’র কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটি রাগান্বিত হয়ে বলেন-
বৃদ্ধ লোক :- মুখ সামলে কথা বলো, মুর্খ ছেলে।
ফারাবী :- দুংখীত আংকেল, আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। আপনি কি আমাদের’কে বাসাটা দেখাতে পারেন?
বৃদ্ধ লোক :- আসো, আসো আমার সাথে।

শীগ্রই আসবে… অধ্যায় – ০২ (কক্ষ নং-০৫)

X
Please Wait ...